জরায়ুর ক্যানসার

মহিলারা তলপেটের যে অংশে সন্তান ধারণ করেন তার নাম Uterus বা জরায়ু। জরায়ুর নিচের দিকে এক ইঞ্চি দৈর্ঘ্য একটি সরু মুখ থাকে যার নাম Cervix বা জরায়ুর মুখ।জরায়ুমুখ ক্যান্সার বা জরায়ুর ক্যান্সার (ইংরেজি: Cervical cancer) নারীদের জন্য একটি ভয়াবহ ব্যাধি এবং জরায়ুমুখ ক্যান্সার বিশ্বব্যাপী নারীদের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। বিশ্বে প্রতি দুই মিনিটে একজন নারী জরায়ুমুখ ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করেন এবং প্রতি বছর ৫০ লক্ষাধিক নারী নতুন করে আক্রান্ত হন।

 

উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মহিলারা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হন জরায়ুর মুখের ক্যানসারে। প্রতি পাঁচজন ক্যানসারে আক্রান্ত মহিলার মধ্যে একজন জরায়ুর মুখের ক্যানসারে আক্রান্ত। সাধারণত ৩৫ থেকে ৫৫ বছর বয়সী মহিলাদের মাঝে এ রোগের প্রকোপ বেশি দেখা যায়।

 

জরায়ুমুখ ক্যান্সার ২০-৫ বছর বয়সের নারীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়, কিন্তু ক্যান্সারের লক্ষণ প্রকাশের প্রায় ২ থেকে ২০ বছর আগেই একজন নারী এ রোগের ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হন। তবে সচেতনতার মাধ্যমে এই রোগ প্রতিরোধ করা যায়। সাধারণত অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের নারীরা স্বাস্থ্য বিষয়ে সম্পূর্ণ সচেতন না বলে এই রোগের বিস্তার বেশি। তবে উন্নত দেশের নারীরা এবিষয়ে সচেতন এবং উন্নত জীবনযাপনের কারণে অনেকটাই এই রোগ থেকে নিরাপদ। জরায়ু-মুখ ক্যান্সার সনাক্ত করার জন্য ‘পেপস স্মেয়ার টেস্ট’ রয়েছে, যা উন্নত দেশের নারীরা দ্বিধাহীনভাবে গ্রহণ করতে পারেন, যা অনুন্নত দেশে গ্রহণ করতে অনেক পারিবারিক ও সামাজিক বাধা রয়েছে।

 

উপযুক্ত চিকিৎসায় শতভাগ আরোগ্য সম্ভব। হিউম্যান পেপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি) হিউম্যান পেপিলোমা বা এইচপি ভাইরাস জরায়ুমুখের ক্যানসারের একটি অন্যতম কারণ, তবে এটি একমাত্র কারণ নয়। যৌন সংযোগে এর সংক্রমণ ঘটে। সংক্রমণের এক যুগেরও বেশি সময় ধরে জরায়ুমুখের স্বাভাবিক কোষ পরিবর্তিত হতে থাকে এবং একসময় তা ক্যান্সারে রূপ নেয়। এ যাবৎ (প্রেক্ষিত ২০১০) ১০০ ধরণের এইচপি ভাইরাস সনাক্ত হয়েছে, যার বেশিরভাগই জরায়ু ক্যান্সারের জন্য অতোটা ঝুঁকিপূর্ণ নয়। তবে এইচপিভি-১৬, এইচপিভি ১৮, এইচপিভি-৬, এইচপিভি-১১ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। স্বাভাবিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত নারীদের জরায়ু প্রায়ই এইচপি ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকে। এতে কোনো উপসর্গ থাকে না বা শারীরিক পরীক্ষায় কোনো চিহ্ন বা ক্ষত পাওয়া যায় না। এর জন্য কোনো চিকিৎসারও প্রয়োজন নেই। শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতাবলে ১৮-২৪ মাসের মধ্যে জরায়ু প্রায় সব এইচপি ভাইরাস থেকে মুক্ত হয়ে যায়। জরায়ুতে এইচপি ভাইরাস দীর্ঘদিন স্থায়ী হলে, জরায়ু কোষে পরিবর্তনের সূত্রপাত হয় এবং ধীরে ধীরে তা ক্যান্সারে রূপ নেয়।

 

পেপস স্মেয়ার টেস্ট বা প্যাপ স্মিয়ার টেস্ট, এজাতীয় ক্যান্সার সনাক্তকরণের একটি সহজ পরীক্ষা। জরায়ুমুখ থেকে রস নিয়ে অণুবীক্ষণযন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা করে ক্যান্সার, ক্যান্সার হওয়ার পূর্বাবস্থা ও জরায়ুমুখের অন্যান্য রোগ যেমন প্রদাহ (ইনফ্লামেশন) সনাক্ত করা যায়। এটি একটি ব্যথামুক্ত ও সাশ্রয়ী পরীক্ষা পদ্ধতি। সাধারণত বিবাহিত নারীদের ২১ বছরের পর থেকে এ পরীক্ষা শুরু করা যেতে পারে এবং দুই বছরে একবার করে পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দেয়া হয়। ৩০ থেকে ৬৪ বছর বয়স পর্যন্ত, যাদের ফলাফল তিনবার 'স্বাভাবিক' এসেছে, তাঁরা প্রতি তিন বছর পর পর এই পরীক্ষা করা উচিত।[২] তবে চিকিৎসকের পরামর্শে এ রুটিনের পরিবর্তন হতে পারে।

 

সাধারণত ১০ বছর বয়সের পর থেকেই কার্যকর প্রতিরোধ হলো জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধক টিকা নেয়া যায়। মোট তিন ডোজ টিকা নিতে হয় mdash; প্রথম ডোজের এক মাস পর দ্বিতীয় ডোজ এবং প্রথম ডোজের ছয় মাস পর তৃতীয় ডোজ টিকা নিতে হয়। টিকা গ্রহণের পাশাপাশি নিয়মিত পরীক্ষা করালে জরায়ুমুখ ক্যান্সারের আক্রমণ হার কমিয়ে আনা যায়। ভাইরাস এইচপিভি-১৬, এইচপিভি-১৮, এইচপিভি-৬, এইচপিভি-১১-এর প্রতিরোধক টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে। আমেরিকার ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) নিয়মানুযায়ী নয় থেকে ২৫ বছর বয়সে এ টিকা কার্যকর হয়। এ টিকা নেওয়া হলে শরীরে উল্লিখিত ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর অ্যান্টিবডি সৃষ্টি হয়। জরায়ুতে ঝুঁকিপূর্ণ ভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আগে থেকে সৃষ্টি হওয়া অ্যান্টিবডি তা ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হয়। দুই ধরনের টিকা আছে। একটি (সারভারিক্স) দুট ভাইরাসের (এইচপিভি-১৬, এইচপিভি-১৮) প্রতিরোধক টিকা, অপরটি (গার্ডাসিল) চারটি ভাইরাসের প্রতিরোধক টিকা। তিনটি ডোজ দিয়ে এ টিকা থাকে। প্রথম ডোজ নেওয়ার এক মাস পর দ্বিতীয় ডোজ এবং ছয় মাস পর তৃতীয় ডোজ দেওয়া হয়। টিকা নেওয়ার পরমুহূর্ত থেকে চার থেকে ছয় বছর এ টিকা কার্যকর থাকে বলে বর্তমানে গণ্য করা হয়। তবে বিবাহিত জীবনযাপনের এ টিকা তেমন কার্যকর হয় না। গর্ভাবস্থায় এ টিকা নেওয়া এখনো অনুমোদিত হয়নি।


এইচভিপি ইনফেকশন হয়ে যাওয়ার পর বা ক্যানসার হয়ে যাওয়ার পর টিকা দিলে কোনো কাজে আসে না। কারণ, এ টিকা ইনফেকশন দমন করতে পারে না এবং ক্যানসারের গতি রুদ্ধ করতে পারে না। এ টিকা গ্রহণকারীকেও নিয়মিত পেপস স্মেয়ার টেস্টে অংশ নিতে হবে।

 

আমাদের দেশে নিম্ন আয়ের পরিবারের মহিলারা অপেক্ষাকৃত বেশি আক্রান্ত হয়। তবে ঔষধি প্রতিরোধকের চেয়ে আচরণগত প্রতিরোধকের দিকে বিজ্ঞানীরা বেশি গুরুত্বারোপ করেছেন। যেমন: প্রজননতন্ত্রের পরিচ্ছন্নতা রক্ষা না করলে, দীর্ঘদিন জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি সেবন, বাল্য বিবাহ, অধিক সন্তান প্রসব; ধুমপান করা (এমনকি পরোক্ষ ধূমপানের স্বীকার হওয়া); পানের সাথে জর্দা, সাদা পাতা, দাঁতের গোড়ায় গুল (তামাকের গুঁড়া) রাখা ইত্যাদি কারণে এই ক্যান্সারে আক্রান্তের সম্ভাবনা বাড়ে। আর সুষম খাবার গ্রহণ; দৈনিক তিন-চারবার ফল, শাকসব্জি, তরকারি খাওয়া; পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, স্বাস্থ্যসম্মত, সুশৃঙ্খল জীবনযাপন ও সামাজিক অনুশাসন মান্য করা এই রোগ প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এছাড়া যাদের স্বামীরা একাধিক মহিলার সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক রাখেন কিংবা যে মহিলারা একাধিক পুরুষের সঙ্গে দৈহিক সম্পর্কে লিপ্ত তাদের ক্ষেত্রে জরায়ুর মুখের ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। এর পাশাপাশি নারীর, নিয়মিত পেপস স্মেয়ার টেস্টে অংশ নেওয়া উচিত, তাতে রোগ আগেভাগে সনাক্ত করা সম্ভব হয়। Herpex Simplex Virus type 2 এবং HPV type16, 18, 31,45 শতকরা ৮০ ভাগ ক্ষেত্রে জরায়ুর মুখের ক্যানসার এর জন্য দায়ী। HPV type16 নিজেই এক্ষেত্রে শতকরা ৫০ ভাগ দায়ী। অধিকাংশ মহিলা তাদের জীবদ্দশায় একাধিক বার HPV দ্বারা আক্রান্ত হন। অনেক সময় সংক্রমণের পর ক্যানসারে রূপ নিতে ২ থেকে ২০ বছর সময় লাগে।

আশার কথা হলো সম্প্রতি
HPV type16, 18 প্রতিরোধে কার্যকর টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে। টিকা গ্রহণের পাশাপাশি নিয়মিত পরীক্ষা বা Screening করালে জরায়ুর মুখ ক্যানসার আক্রান্তের হারকে কামিয়ে আনা সম্ভব।

জরায়ুর ক্যান্সার বা জরায়ুর সমস্যার জন্য প্রথমে আপনাকে কিডনি ও ইউরলজি স্পেশালিষ্ট এর কাছে যেতে হবে, তার পরামর্শ মোতাবেক পরবর্তীতে অংকলজিষ্ট এর নিকট যেতে হবে।

 

লক্ষণসমূহ:

প্রাথমিক অবস্থায় জরায়ুর মুখের ক্যানসার তেমন কোনো লক্ষণ প্রকাশ নাও করতে পারে। রক্ত মিশ্রিত গন্ধযুক্ত সাদা স্রাব, মাসিক অনিয়মিত হওয়া, ২ মাসিকের মধ্যবর্তী সময়ে রক্ত স্রাব যাওয়া, মাসিক বয়সকালে বন্ধ হয়ে যাবার পর নতুন করে রক্তক্ষরণ হওয়া, সহবাসের পর রক্তক্ষরণ হওয়া, কোমর তলপেট উরু ও পায়ে ব্যথা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দিতে পারে।


প্রাথমিক পর্যায়ে জরায়ুর মুখের ক্যানসার নির্ণয়ে ২টি সহজ পদ্ধতির নাম
Pap smear এবং VIA. VIA পদ্ধতিতে জরায়ুর মুখটি ভালোভাবে উজ্জ্বল আলোর সাহায্যে ওষুধের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়। পর্যবেক্ষণে যদি জরায়ুর মুখের রং বদলে সাদা বর্ণ ধারণ করে তবে তাকে VIA.Positive বলা হয়। এই সাদা বর্ণ অল্প সময় স্থায়ী হয়। ওষুধ ব্যবহারে জরায়ুর মুখের রংয়ের পরিবর্তন না হলে তাকে ভায়া VIA.Negative বলে


যদি ভায়া Positive হয় তবে কলপোসকপি ও বায়োপসি পরীক্ষার মাধ্যমে ক্যানসার নিশ্চিত করা হয়। আর যদি VIA Negative হয় তবে ৩ বছর পর আবার VIA পরীক্ষা করতে বলা হয়। অতি অল্প সময়ে ভায়া পরীক্ষা করা হয়। এতে কোনো প্রকার কাটাছেঁড়া বা ব্যথা লাগে না। খুব সহজে জরায়ু মুখের ক্যানসার পরীক্ষা করা যায়।

প্রাথমিক পর্যায়ে জরায়ুর মুখের ক্যানসার শনাক্তের আরও একটি পরীক্ষার নাম Pap smear৪০ বছর বয়সের মধ্যে প্রতিটি বিবাহিত মহিলার ১বার Pap smear করা উচিত।


ডাক্তার এর তালিকার জন্য লিটল বাংলা জেনারেল সার্জন অংশে প্রবেশ করুন বা  লিংকে প্রবেশ করুনঃ  http://littlebangladc.blogspot.com