কিডনির পাথর

মূত্রতন্ত্রের যত রোগ আছে, এর মধ্যে পাথরজনিত রোগ সবচেয়ে বেশি। প্রতি ২০ জনের মধ্যে একজন কিডনির পাথরে ভোগে। কিডনি পাথর তৈরির উপাদানগুলো বেশি পরিমাণে শরীরে তৈরি হলে কিডনি যতটুকু প্রস্রাবের মাধ্যমে পরিষ্কার করতে পারে তার পরও অতিরিক্ত উপাদান কিডনিতে রয়ে যায়। এর ফলে সব উপাদান একট নিউক্লিয়াস তৈরি করে পরবর্তীতে এর ওপর অতিরিক্ত উপাদানগুলো জমা হতে হতে কিডনি স্টোন তৈরি হয়। ট্রিপল স্টোনের জন্য জীবাণু ঘটিত প্রদাহ বিশেষত প্রটিয়াস এবং স্টাফাইলোকক্কাই ব্যাকটেরিয়া দিয়ে প্রস্রাবে ইনফেকশন হলে এসব জীবাণু ইউরিককে এমোনিয়ায় রূপান্তর করে। ফলে এমোনিয়া জমা হতে হতে এ ধরনের স্টোন তৈরি হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার আগেই ছোট পাথরগুলো প্রস্রাবের সঙ্গে বের হয়ে যায়। কিন্তু যেগুলো উপসর্গ তৈরি করে তাদের চিকিৎসা নিতে হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বড় রকমের কোনো সার্জারি প্রয়োজন হয় না। এখন পাথর হওয়া প্রতিরোধ করাও সম্ভব।কিডনির পাথর সাধারণত আকারে ছোট হয়ে থাকে। কিডনির ভিতরে কঠিন পদার্থ জমা হয়ে কিডনিতে পাথর হয়। সাধারণত খনিজ এবং অম্ল লবণ দিয়ে কিডনির পাথর তৈরি হয়। কিডনিতে বিভিন্ন কারণে পাথর হয়ে থাকে। তবে প্রস্রাব গাঢ় হলে তা খনিজগুলোকে দানা বাঁধতে সহায়তা করে এবং তা পাথরে রূপ নেয়।

লক্ষণ ও উপসর্গ:

মূত্রনালীতে পাথর না যাওয়া পর্যন্ত কিডনিতে পাথর হওয়ার কোন লক্ষণ ও উপসর্গ সাধারণত বুঝা যায় না। কিডনিতে পাথর হলে সাধারণত: যেসব লক্ষণ ও উপসর্গ গুলো দেখা দেয়:

পিঠে, দুই পাশে এবং পাঁজরের নিচে ব্যথা হওয়া ও তলপেট এবং কুঁচকিতে ব্যথা ছড়িয়ে যাওয়া । প্রস্রাব ত্যাগের সময় ব্যথা হওয়া। প্রস্রাবের রঙ গোলাপী, লাল অথবা বাদামী হওয়া। বারবার প্রস্রাবের বেগ পাওয়া। যদি কোন সংক্রমণ হয়ে থাকে তাহলে জ্বর এবং কাঁপুনী হওয়া। বমি বমি ভাব এবং বমি হওয়া। যাদের প্রস্রাবের প্রদাহ বেশি হয়, টিউবুলার এসিডোসিস রয়েছে, তাদেরও। টিউবুলার এসিডোসিস একটি বংশগত রোগ। এই রোগীর ৭০ শতাংশের কিডনিতে পাথর হয়।

 

কাদের কিডনিতে পাথর বেশি হয়

যাদের কিডনিতে পাথর হবার সম্ভাবনা বেশি রয়েছে তারা হলেন পরিবারের কারো কিডনিতে পাথর হলে অথবা যাদের একবার  কিডনিতে পাথর হয়েছে তাদের, চল্লিশ এবং চল্লিশোর্ধ ব্যক্তিদের, পুরুষদের, যাদের পানি কম পান করার কারণে শরীরে পানিশূণ্যতা দেখা দিয়েছে, যারা উচ্চ আমিষ, উচ্চ সোডিয়াম এবং উচ্চ চিনিযুক্ত খাবার খান তাদের, স্হূলকায়দের, যাদের খাদ্যনালীর রোগ/ শল্য চিকিসার কারণে হজম প্রক্রিয়ার পরিবর্তন হয়ে পাথর তৈরীর উপাদান গুলো শরীরে শোষিত হয় তাদের, যাদের আগে থেকে কিডনির সমস্যা, যেমন: মূত্রতন্ত্রের সংক্রমণ, সিস্টিন ইউরিয়া ছাড়াও প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থির অতিক্রিয়া আছে তাদের

পরীক্ষা-নিরীক্ষা:

  • এক্স-রে, কম্পিউটারাইজড টমোগ্রাফী (CT)

  • প্রস্রাবের পরীক্ষা

  • রক্তের পরীক্ষা

  • আগে পাথর হয়ে থাকলে সেই পাথরের বিশ্লেষণ (Analysis of Passed Stones)

কিডনিতে পাথরের ধরণ:

  • ক্যালসিয়াম পাথর (Calcium stones) : বেশিরভাগ কিডনির পাথর ক্যালসিয়াম পাথর। সাধারণত খাদ্য ব্যবস্থা (কিছু কিছু শাক-সবজি, ফলমূল, বাদাম এবং চকলেট উচ্চ মাত্রায় অক্সলেট আছে), উচ্চ মাত্রার ভিটামিন ডি, অন্ত্রের বাইপাস সার্জারি এবং বিভিন্ন ধরণের গ্রহণ বিপাকীয় সমস্যার কারণে প্রস্রাবে ক্যালসিয়াম ঘণীভূত হয়। ক্যালসিয়াম পাথর অনেক সময় ক্যালসিয়াম ফসফেট আকারেও হয়।

  • স্ট্রুভাইট পাথর (Struvite Stone) : সাধারণত মূত্রাধারে (Urineary tarct) সংক্রমণের কারণে Struvite stone হয়। এগুলো খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং বেশ বড় হয়।

  • ইউরিক এসিড পাথর (Urine Acid Stones) : যাদের পানিশূন্যতা আছে, উচ্চ আমিষযুক্ত খাদ্য গ্রহণ করে এবং গেঁটে বাত (Gout) আছে তাদের এই পাথর হয়। এছাড়া জীনগত কিছু কারণে এবং রক্তের কলায় সমস্যা থাকলেও এই পাথর হয়।

  • সিস্টিন পাথর (Cystine Stone) : সাধারণত বংশগত কোন সমস্যার কারণে এই পাথর হয়। এর ফলে কিডনি থেকে অতিরিক্ত পরিমাণ এমিনো এডিস বের হয়ে যায়।

এছাড়া কিডনিতে অন্যান্য ধরণের পাথরও হয়ে থাকে।


আকারে ছোট এবং সামান্য উপসর্গ যুক্ত পাথর:

বেশীরভাগ কিডনি পাথরের ক্ষেত্রে তেমন কোন চিকিসার প্রয়োজন হয় না। এক্ষেত্রে যা করা যেতে পারে তা হল প্রতিদিন ২ থেকে ২.৫ লিটার পানি পান ও ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যথানাশক ঔষধ সেবন।

আকারে বড় এবং উপসর্গ যুক্ত পাথর: 

শ্বদ তরঙ্গ ব্যবহার করে পাথর ভাঙ্গা/ধ্বংস করা বা অনেক বড় পাথর অপসারণের জন্য অপারেশন করা বা ইউরেটেরোস্কোপ (Ureteroscope)ব্যবহার করে পাথর অপসারন করা।


চিকিৎসা

পাথরের আকার যদি এত বড় হয় যে নিজে থেকে বের হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই তাহলে অপারেশন এর প্রয়োজন হয়। এ ছাড়া যদি বারবার প্রস্রাবের ইনফেকশন হয়, পাথরের কারণে কিডনি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়, পাথরের আকার বেড়েই চলে, পাথরের কারণে প্রস্রাবের সঙ্গে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়, তাহলে অপারেশন লাগে। প্রধানত চার ধরনের অপারেশন রয়েছে। এগুলো হলো, এক্সট্রা করপোরিয়াল শকওয়েভ লিথোট্রিপসি (ইএসডব্লিউএল), পিসিএনএল, ইউরেটেরোস্কোপিক পদ্ধতি ও ল্যাপারোস্কোপিক পদ্ধতি।


ইএসডব্লিউএলঃ এ ব্যবস্থায় শক্তিশালী তরঙ্গ পাথরে আঘাত করে টুকরো টুকরো করে দেয়। পরে টুকরো পাথর প্রস্রাবের সঙ্গে বেরিয়ে আসে। বেশি বড় পাথর হলে এবং সংখ্যায় বেশি হলে এই পদ্ধতিতে তা বের করা যায় না। বৃক্কনালি ও মূত্রথলির পাথর এই ব্যবস্থায় বের করে আনা সম্ভব নয়। এই পদ্ধতির সুবিধা হলো মাত্র ২০-৩০ মিনিট সময় লাগে। রোগীকে অজ্ঞান করা হয় না। চিকিৎসার দু-তিন ঘণ্টা পর রোগীকে ছেড়ে দেওয়া হয়।


পিসিএনএলঃ যদি পাথরের আকার বড় হয়, তখন ভাইব্রেশন দিয়ে কিডনির পাথর গুঁড়ো করা হয়, যা প্রস্রাবের সঙ্গে নেফ্রোসটমি টিউব দিয়ে বেরিয়ে আসে। পরে প্রয়োজনবোধে ইএসডব্লিউএল করা হয়।


ইউরেটেরোস্কোপিকঃ এই ব্যবস্থায় ছোট্ট ফাইবার স্কোপ মূত্রপথ, প্রস্রাবের থলি হয়ে বৃক্কনালি থেকে পাথর গুঁড়ো করে অথবা বাক্সেট দিয়ে ধরে পাথর বের করে নিয়ে আসা হয়।

ল্যাপারোস্কোপিকঃ এখন এই পদ্ধতিতে বিভিন্ন অস্ত্রোপচার করা হচ্ছে। ছোট ছোট দু-তিনটি ছিদ্র করে ক্যামেরার মাধ্যমে সহজেই পাথর বের করা যায়। এই ব্যবস্থায় জটিলতাও কম।


কিডনির পাথর প্রতিরোধ:

সারাদিনে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা ২.৫ থেকে লিটার, বেশী অক্সালেটযুক্ত খাবার যেমন-পালংশাক, বীট, মিষ্টি আলু, চা, চকোলেট এবং সয়াজাতীয় খাদ্য পরিহার করা, খাবারে লবণ কম ব্যবহার করা এবং পরিমাণে অল্প প্রাণীজ আমিষ গ্রহণ করা,

আগে ধারণা করা হতো, ক্যালসিয়াম-জাতীয় খাবার খেলে ক্যালসিয়াম পাথর বেশি হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, খাবারের সঙ্গে ক্যালসিয়াম খাদ্যনালিতে পাথর সৃষ্টিকারী অক্সালেটের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পায়খানার সঙ্গে বের করে দেয়। কাজেই ক্যালসিয়ামযুক্ত খাবার, যেমন-দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার খাওয়া যাবে। তবে যাদের একটি কিডনিতে একবার পাথর হয়েছে, তাদের অপ্রয়োজনীয় ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট ও ভিটামিন ডি খাওয়া একেবারেই অনুচিত কেননা ক্যালসিয়াম স্টোন হলে দুধ, ছানা, চিজ, পালংশাক প্রতিদিন ডিম এইসব খাবার খেতে হবে পরিমাপ মতো।

যাদের কিডনিতে একবার পাথর ধরা পড়েছে, তাদের ভিটামিন ডি-জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। মাংস, মাছ ও পোলট্রি-জাতীয় খাবার কম খেতে হবে, কেননা ইউরিক এসিড স্টোন মাছ, মাংস, ডিম থেকে এটা হয়। তাছাড়া যাদের অক্সালেট স্টোন হয়েছে তাদের কচু, আমলকী, ওল ইত্যাদি না খাওয়াই ভালো। রেডমিট, অতিরিক্ত তেল, ঘি, মাখন, ভাজাভুজি খাবেন না। যাদের ইপারপ্যারাথাইরয়েড রোগ রয়েছে, তাদের দ্রুত তা অস্ত্রোপচার করা উচিত।