হার্নিয়া বা হারনিয়া

হার্নিয়া বা হারনিয়া অতি কমন একটি রোগ। জন্ম থেকে শুরু করে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত যে কারো এই রোগ হতে পারে। আসলে হারনিয়া একটি সার্জিক্যাল রোগ অর্থাৎ অপারেশন ছাড়া এ রোগ ভালো হবার নয়। সাধারণভাবে হারনিয়া হলো পেটের মধ্যস্থ খাদ্যনালী বা অন্য যেকোনো অঙ্গ পেটের দুর্বল স্থান দিয়ে বাহিরে চলে আসাকে বুঝায়। তলপেটের ইনগুইনাল বা কুঁচকির কাছের অংশে একাধিক মাংসপেশীর মধ্যে তির্যকভাবে একটি নালীপথ আছে যাকে ইনগুইনাল ক্যানেল বলা হয়। মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থায় সুড়ঙ্গ পথ সদৃশ এই নালীপথ বেয়ে অন্ডুকোষদ্বয় উদর গহ্বরের ভিতর হতে অণ্ড থলিতে নেমে আসে। গুণগতভাবেই এটি একটি দুর্বল স্থান।

হারনিয়ার কারণ


পেট বা এবডোমেন ওয়ালের দুর্বলতাই হারনিয়ার একমাত্র কারণ। এই দুর্বলতা বিভিন্ন কারণে হতে পারে, যেমন- জন্মগত, অপারেশন, আঘাত এবং ইনফেকশন ইত্যাদি। সবচেয়ে কমন যে হারনিয়া আমরা পেয়ে থাকি তার মধ্যে ইনগুইনাল হারনিয়া এবং ইনসিসনাল হারনিয়া বা অপারেশনের জায়গায় হারনিয়া।

 

ইনগুইনাল হারনিয়া কুচকির মাঝামাঝি ১/২ ইঞ্চি উপরে এই হারনিয়ার প্রাথমিক অবস্থান। ইনগুইনাল হারনিয়া যে কোন বয়সেই এ রোগ হতে পারে এবং বেশির ভাগ রোগীই পুরুষ। জন্মলগ্নেই পুরুষ শিশুর হার্নিয়া থাকতে পারে। এই অবস্থাকে জন্মগত হার্নিযা বলা হয়। সুস্থ সবল শরীরে পরবর্তীতে যে কোন বয়সেই হার্নিয়া সম্পূর্ণ নতুনভাবে দেখা দিতে পারে। এ ধরনের হার্নিয়াকে অর্জিত হার্নিয়া বলা হয়। জন্মগত হার্নিয়া মূলত জন্মগত গাঠনিক ত্রুটি। অর্জিত হার্নিয়া সমস্যা সৃষ্টির পিছনে কিছু কারণ কাজ করতে পারে। উদর গহ্বরের অভ্যন্তরস্থ চাপ বৃদ্ধিকারী কারণগুলোই এক্ষেত্রে প্রধান। সঙ্গে তলপেটের মাংসপেশীর দুর্বলতাও বিশেষভাবে অনুঘটক যা বয়স্কদের বেলায় বিশেষভাবে প্রযোজ্য। উদর গহ্বরের চাপ বৃদ্ধি সহায়ক পরিস্থিতিসমূহ হচ্ছে দীর্ঘ মেয়াদী কাশি, পেটে চাপ পড়ে এমন পেশার কাজ যেমন ভারোত্তোলন, প্রবল চাপ দিয়ে প্রস্রাব করতে হয় এমন কোন অসুখ, দীর্ঘস্থায়ী কোষ্ঠকাঠিন্য এ ক্ষেত্রে মলত্যাগের সময় খুব চাপ পড়ে, যেমন বৃদ্ধ বয়সে প্রোস্টেট গ্রন্থি বড় হওয়া ইত্যাদি। যেসব শিশু স্বাভাবিক জন্মগ্রহণের তারিখের আগেই ভূমিষ্ঠ হয় তাদের ইনগুইনাল হার্নিয়া বেশি হয়।

রোগের লক্ষণ

প্রাথমিক পর্যায়ে রোগীরা বলবে হাঁটা-চলা করলে, ভারী বস্তু উঠালে কিংবা হাচি-কাঁশি দিলে আমার কুচকীর উপরটা গোলাকার বলের মত ফুলে উঠে এবং শুয়ে থাকলে এটা চলে যায়। মাঝে মাঝে শক্ত হয়ে যায় এবং ব্যথা হয়। কিছুদিন এভাবে চলার পর গোলাকার ফোলাটি ইসক্রুটামে (অন্ডকোষ থলিতে) নেমে আসে এবং শুয়ে থাকলে আপনা আপনি পেটের ভিতর শব্দ করে চলে যায়। এভাবে ফোলাটি বড় হতে থাকে এবং মাঝে মাঝে চাপ দিয়ে ভিতরে ঢোকাতে হয়। তারপর ধীরে ধীরে এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছতে পারে যে এটি আর চাপ দিলেও পেটের ভিতরে ঢুকছে না। এই পর্যায়ে প্রচণ্ড ব্যথা, বমি এবং পেট ফাঁপা ও পায়খানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এই অবস্থাকে ইনটেন্সিটিনাল বা খাদ্যনালীর অবস্ট্রাকশন বলা হয়। এই অবস্থায় জরুরীভাবে অপারেশন না করলে জীবনমরণ সমস্যা হতে পারে।

চিকিৎসাঃ অপারেশনই হচ্ছে এই রোগের একমাত্র চিকিৎসা। ছোট এবং প্রাথমিক পর্যায়ে অপারেশন করানোই উত্তম। কারণ এতে খরচ কম, যে কেইস হিসাবে চিকিৎসা করা যায়। মেস লাগানো ছাড়া করা যায় এবং জীবনের ঝুকি কম।

জটিলতা  

অপারেশনের মাধ্যমে হার্নিয়া ঠিক না করলে ক্রমে হার্নিয়া বড় হতে থাকে। বড় হার্নিয়া চারপাশের টিস্যুর ওপর চাপ প্রয়োগ করে-পুরুষের ক্ষেত্রে হার্নিয়ার সবচেয়ে মারাত্মক জটিলতা হলো যখন অন্ত্রের অংশ পেটের দেয়ালের দুর্বল জায়গায় আটকে যায়। এ সময়ে প্রচণ্ড ব্যথা হয়, বমি বমি ভাব ও বমি হয় এবং পায়খানা বন্ধ হয়ে যায়, কিংবা বায়ু চলাচল করতে পারে না। এ ক্ষেত্রে অন্ত্রের আটকে পড়া অংশে রক্ত চলাচল কমে যায়-এ অবস্থাকে বলে স্ট্রাংগুলেশন-যার কারণে আক্রান্ত অন্ত্রের টিস্যুর মৃত্যু ঘটতে পারে। স্ট্রাংগুলেটেড হার্নিয়া একটি জীবন মরণ সমস্যা, এ ক্ষেত্রে জরুরি অপারেশনের প্রয়োজন হয়।

ইনসিসনাল হারনিয়া/অপারেশনের স্থানে হারনিয়াঃ অপারেশনের পর অপারেশনের স্থানে ইনসিসনাল হারনিয়া দেখা দেয়। রোগী বলবে আমার অপারেশন লাইনটির সম্পূর্ণ স্থানে অথবা আংশিক জুড়ে ফুলে উঠে। বিশেষ করে হাঁটা-চলা, হাচি-কাঁশি বা ভারী বস্তু উত্তোলন করলে এবং শুলে দেখা যায় না।

ইনসিসনাল হারনিয়াঃ

এটি সাধারণত হয় ইমারজেন্সী অপারেশন করলে, অপারেশনের জায়গা পেকে গেলে এবং অদক্ষ সার্জন দ্বারা অপারেশন করলে এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ইনসিসনাল হারনিয়ার রোগীর ইনগুইনাল হারনিয়া রোগীদের মত একই কম উপসর্গ ও জটিলতা নিয়ে ডাক্তার এর কাছে আসে।

চিকিৎসা

যদি আপনার হার্নিয়া ছোট থাকে এবং আপনার কোনো সমস্যা সৃষ্টি না করে তাহলে আপনার চিকিৎসক পর্যবেক্ষণ করার কথা ও অপেক্ষা করার কথা বলতে পারেন। কিন্তু হার্নিয়া যদি বড় হতে থাকে এবং ব্যথা হয় তাহলে অস্বস্তি দূর করতে ও মারাত্মক জটিলতা প্রতিরোধ করতে সাধারণত অপারেশনের প্রয়োজন হয়। সার্জারীই একমাত্র চিকিৎসা এবং অপারেশন না করলে ইনগুইনাল হারনিয়ার মত জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। অভিজ্ঞ সার্জন দ্বারা অপারেশন করিয়ে নিলে আবার হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। অতএব হারনিয়া হলে জরুরীভিত্তিতে অভিজ্ঞ সার্জনের শরণাপন্ন হওয়া আবশ্যক।হার্নিয়ার দুধরনের সাধারণ অপারেশন করা হয়ঃ

হার্নিয়োর‌্যাফি

এ পদ্ধতিতে আপনার সার্জন আপনার কুঁচকিতে একটা ইনসিশন দিয়ে বেরিয়ে আসা অন্ত্রকে ঠেলে পেটের মধ্যে ফেরত পাঠান। তারপর দুর্বল বা ছেঁড়া মাংসপেশি সেলাই করে ঠিক করে দেন। অপারেশনের পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আপনি চলাফেরা করতে পারবেন, তবে স্বাভাবিক কাজ কর্মে ফিরে যেতে আপনার চার থেকে ছসপ্তাহ সময় লাগতে পারে।

হার্নিয়োপ্লার্স্টি

এ পদ্ধতিতে আপনার সার্জন কুঁচকি এলাকায় এক টুকরো সিনথেটিক মেশ লাগিয়ে দেন। সেলাই, ক্লিপ অথবা স্টাপল করে এটাকে সাধারণত দীর্ঘজীবী রাখা হয়। হার্নিয়ার ওপরে একটা একক লম্বা ইনসিশন দিয়েও হার্নিয়াপ্লাস্টি করা যেতে পারে। বর্তমানে ল্যাপারোস্কপির মাধ্যমে, ছোট ছোট কয়েকটি ইনসিশন দিয়ে হার্নিয়োপ্লাস্টি করা হয়। তবে হার্নিয়া বড় হলে ল্যাপারোস্কপির মাধ্যমে করা যায় না।

হার্নিয়ার অপারেশন বড় কোনো অপারেশন নয়, এর ঝুকিও খুব সামান্য অপারেশনের পরে রোগীর কাশি হলে, কোষ্ঠ কাঠিন্য হলে, পেট ফুলে গেলে, শ্বাস কষ্ট হলে বা ডায়াবেটিস বেড়ে গেলে সাথে সাথে এর চিকিৎসা করাতে হবে অন্যথায় খুব সফল একটা অপারেশন ব্যর্থতায় পর্যবশিত হতে পারে

 

প্রতিরোধ

যদি আপনার জন্মগত ত্রম্নটি থাকে যার কারণে ইনগুইনাল হার্নিয়া হতে পারে-সেটা আপনি প্রতিরোধ করতে পারবেন না।যদি আপনার স্বাভাবিক ওজনের চেয়ে বেশি থাকে, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ব্যায়াম ও খাদ্যগ্রহণ করুন। উচ্চ আঁশ কোষ্ঠকাঠিন্য ও টানটান অবস্থা প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে।পারত পক্ষে ভারী বস্তু উত্তোলন করবেন না। যদি একান্তই উত্তোলন করতে হয় তাহলে সর্বদা হাঁটু ভাঁজ করে শুরু করবেন, কখনো কোমর বাঁকাবেন না।

ধূমপান আপনার মারাত্মক রোগ যেমন ক্যান্সার, এমফাইসেমা ও হ্নদরোগের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। এ ছাড়া ধূমপান সচরাচর দীর্ঘস্থায়ী কাশির সৃষ্টি করে, যা ইনগুইনাল হার্নিয়া সৃষ্টিতে উৎসাহ জোগায়।

যে কোন সার্জন দিয়ে হার্নিয়া অপারেশন করা যায়, তবে কিডনি ও ইউরলজি রিলেটেড ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া ভাল।

ডাক্তার এর তালিকার জন্য লিটল বাংলা জেনারেল সার্জন অংশে প্রবেশ করুন বা লিংকে প্রবেশ করুনঃ http://littlebangladc.blogspot.com