অর্শ্ব বা পাইলস

চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে কয়েক আউন্স ভুসির অভাবে আজ ইউরোপের ইতিহাস অন্যভাবে রচিত হয়েছে। কারণ ওয়াটারলুর যুদ্ধে নেপোলিয়ন পাইলসে আক্রান্ত থাকায় সঠিক নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হননি। খাদ্যে আঁশ জাতীয় খাবার কম থাকার কারণে নেপোলিয়ন তীব্র পাইলস সমস্যায় ভুগছিলেন বলে এ উক্তি করা হয়েছে।

পাইলস বলতে বোঝায়, মলদ্বারে ফুলে ওঠা মাংসপিণ্ড বা গ্যাজ। অসংখ্য শিরা মিউকাস ঝিল্লির তলায় ফুলে ওঠার কারণে মাংসপিণ্ড ফুলে ওঠে এবং কখনো কখনো রক্ত যায়। পাইলসের চিকিৎসা বিজ্ঞানের নাম হলো হেমোরয়েড। হেমোরয়েড অর্থ হলো টয়লেটে রক্ত যাওয়া। অভ্যন-রীণ পাইলসে মাংসপিণ্ড না থাকলেও প্রচুর রক্ত যেতে পারে। আবার অনেক বড় গ্যাজ আছে কিন্তু রক্ত নাও যেতে পারে। এ রক্ত যাওয়ার আবার তারতম্য আছে। তবে সাধারণত কয়েক দিন থেকে কয়েক মাস পরপর রক্ত যায়। শিশুদের পাইলস হলে বড়দের চেয়ে বেশি রক্ত যায়।

কারণঃ

পাইলস কোনো বিশেষ একটি কারণের জন্য হয় না। অনেকগুলো কারণ এ জন্য দায়ী। যার অন্যতম হচ্ছে উত্তরাধিকার, জন্মগতভাবে যদি রক্তনালি দুর্বল থাকে, দীর্ঘদিন ধরে কাশি থাকলে, গঠনগত বৈশিষ্ট্য, পুষ্টি, পেশা, আবহাওয়া, মানসিক সমস্যা, বার্ধক্য, হরমোনের পরিবর্তন, খাদ্য ও ওষুধ, সংক্রমণ, অন্তঃসত্ত্বা, ব্যায়াম, মলত্যাগের শক্তিপ্রয়োগ, প্রস্রাব করার সময় তীব্র চাপ দিতে হলে, বমি, প্রায়ই ভারী কিছু বহন করতে হলে, আঁটসাঁটো কাপড় পরা ও কোষ্ঠকাঠিন্য। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেহের গঠনকে ধরে রাখার কলার ক্ষয় হতে থাকে যার কারণে মলদ্বারের ভেতরের কুশনটি ঢিলা হয়ে ঝুলে পড়তে থাকে। এমতাবস্থায় শিরাগুলো স্ফীত হতে থাকে এবং রক্তপাত হতে থাকে।

লক্ষণ:

এ রোগে রোগীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মলদ্বারে রক্ত পড়ার অভিযোগ করেন। এটি সাধারণত মলত্যাগের সময় অথবা তার পরে হয়ে থাকে। মলত্যাগের শক্তি প্রয়োগ করা অথবা বারবার মলত্যাগ করলে রক্ত যাওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। এটা কমোডে বা টয়লেট পেপারে দেখা যেতে পারে। অতিরিক্ত রক্ত যাওয়ার কারণে তীব্র রক্তশূন্যতা দেখা দিতে পারে। পাইলসে সাধারণত ব্যথা হয় না। কিন্তু যদি থ্রম্বসিস (রক্ত জমাট বাঁধা) ঘা অথবা পচন ধরে তখন ব্যথা হতে পারে। মলদ্বারে ব্যথার প্রধান কারণ এনালফিশার।

মলদ্বারের ভেতর থেকে মাংসপিন্ড ঝুলে পড়া বা গেজ হওয়া একটি সাধারণ ঘটনা। এটি হলে  কখনও কখনও হাত দিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে দিতে হয়। এমন হতে পারে যে এটা বাইরে ঝুলে আছে এবং কখনও ভেতরে যায় না। মাঝে মধ্যে মলদ্বারে চুলকানি হতে পারে। পাইলসের জন্য কোষ্ঠকাঠিন্য হয় না। কিন্তু ঘন ঘন পায়খানা হলে  অথবা থ্রম্বসিস হলে অনেকে রক্তপড়া বা ব্যথার জন্য টয়লেটে যেতে চায় না যার জন্য আস্তে আস্তে কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দেয়।

প্রতিরোধ:

উচ্চ আশঁযুক্ত খাবার, ফলমূল এবং শাক-সবজি বেশি বেশি করে খেতে হবে। গরু এবং খাসির মাংস কম খাওয়া উচিত। প্রতি দিন ৮-১০ গ্লাস পানি এবং তরল জাতীয় দ্রব্য পান করতে হবে, মলত্যাগের সময় কষা হলে বেশি চাপ প্রয়োগ করা যাবে না, ইসপগুলের ভুসি এ ব্যাপারে উপকারী। পায়খানা চেপে রাখা যাবে না, ব্যায়াম করলে তা পায়খানার কষাভাব দূর করতে সাহায্য করবে, অনেকক্ষন ধরে দাঁড়িয়ে বা বসে থাকা থাকা যাবে না। কোষ্ঠকাঠিন্য এবং ডায়রিয়া বা আমাশয়ের সময়মতো যথাযথ চিকিৎসা করা উচিত। টয়লেটে অনেকক্ষণ বসে বই পড়া বা অহেতুক দীর্ঘক্ষণ বসে থাকা উচিত নয়।

পরীক্ষা-নিরীক্ষা:
সিগময়ডস্কপি - মলদ্বার, পায়ুপথ ও বৃহদান্ত্রের ভেতরে এ যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা করতে হয়।
প্রকটস্কপি - এ যন্ত্র দিয়ে মলদ্বার ও পায়ুপথের নিচের দিক পরীক্ষা করতে হয়। রোগী যদি ৫০ বছর বয়সের ঊর্ধ্বে হয় এবং যদি পরিবারে কেউ বৃহদান্ত্র ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে থাকে তাহলে বেরিয়াম এনেমা বা কোলনস্কপি করা উচিত।

চিকিৎসা:

পাইলসের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন চিকিৎসা রয়েছে। যদি কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় তার চিকিৎসা করতে হবে যেমন ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্য। ক্যান্সার অথবা বৃহদান্ত্রের অন্য কোনো রোগ আছে কিনা অবশ্যই দেখে নিতে হবে।

আধুনিক যন্ত্রের সাহায্যে বিনা অপারেশনে ৮০-৯০% পাইলসে চিকিৎসা যায়। এ পদ্ধতিতে ছোট যন্ত্রের সাহায্যে পাইলসে চিকিৎসা করলে সপ্তাহ খানেকের ভেতর পাইলসের মাংসপিন্ডটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে কেটে পড়ে যায়। চিকিৎসার সময় বা পরে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোনোরূপ ব্যথা হয় না। কোনো অজ্ঞান বা অবশ করার প্রয়োজন নেই। প্রখ্যাত আমেরিকান সার্জন ডা. মারভিন এল করমান ও ডা. ডিএস স্টিনবার্গ এ পদ্ধতিতে চিকিৎসা করে বলেন, এ পদ্ধতিটি আবিষকারের ফলে ৮০-৯০% রোগী বিনা অপারেশনে ভালো হয়েছে। চিকিৎসায় ব্যয় খুবই কম। এ পদ্ধতি ব্যবহারের পূর্বে এনেমা দিলে ভালো হয়। পায়ুপথের ভেতর যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা করে নিতে হয়। যেহেতু আমাদের শরীরে প্রধান তিনটি পাইলস আছে অতএব সর্বোচ্চ তিনবার এরূপ চিকিৎসা লাগতে পারে। দুবার চিকিৎসার মধ্যে সাধারণত ৩-৪ সপ্তাহ ব্যবধান থাকতে হয়।

লংগো পদ্ধতি

এই প্রেক্ষাপটে অধ্যাপক ডা. এন্টনিও লংগো, অধ্যাপক সার্জারি, ইউনিভার্সিটি অব প্যালেরমো, ইতালি ১৯৯৩ সালে একটি অত্যাধুনিক পদ্ধতি আবিষ্কার করেন, যার নাম
Longo Operation Stapled Haemo˨oidectomyঅর্থাত্ অত্যাধুনিক যন্ত্রের সাহায্যে মলদ্বার না কেটে পাইলস অপারেশন। এ পদ্ধতির চিকিত্সার দর্শন যুক্তি সম্পূর্ণ আলাদা। এক্ষেত্রে পাইলসটিকে একটি ঝুলেপড়া মাংসপিণ্ড হিসেবে মনে করা হয়। এই ঝুলে পড়া মাংসপিণ্ডের ভেতর অসংখ্য শিরা মলত্যাগের সময় প্রচণ্ড চাপে রক্তপাত ঘটায়। বিশেষ ধরনের যন্ত্রের সাহায্যে অপারেশনের ফলে ঝুলেপড়া পাইলস ভেতরে ঢুকে যাবে। এ যন্ত্রটি রেকটামের ভেতর একটি চক্রাকার মাংসপিণ্ড কেটে নিয়ে আসে। কাটা-ছেঁড়া করে ওই যন্ত্রটি আবার সেলাইও সেরে দেয়; যার কারণে কোনো ক্ষতস্থান থাকে না। আর ক্ষতস্থান থাকে না বলে শুকানোর প্রশ্নই আসে না। এ অপারেশনের পর কোনোরূপ ব্যথা হয় না। তবে মলদ্বারে কিছু নাড়াচাড়া করা হয়, যার ফলে অপারেশনের পর অল্প ব্যথা হতে পারে। এ পদ্ধতিতে পাইলসের উত্পত্তিস্থল অর্থাত্ রেকটামের ভেতর অপারেশনের ফলে পাইলসের রক্ত সরবরাহের শিরাগুলো বন্ধ হয়ে যায়। এ পদ্ধতিতে গঠনগত দিক থেকে মলদ্বার সম্পূর্ণ অক্ষত থাকে। মলদ্বারে সামান্যতম কোনো কাটা-ছেঁড়া নেই। এতে মলদ্বার সরু হয়ে যাওয়ার সমস্যা নেই। দীর্ঘদিন ব্যথার ওষুধ ও এন্টিবায়োটিক খাওয়ার প্রয়োজন নেই। দীর্ঘদিন বিশ্রাম বা ছুটি নেয়ার প্রয়োজন নেই। পায়খানা আটকে রাখার ক্ষমতা ব্যাহত হওয়ার ভয় নেই। সর্বোপরি আবার পাইলস হওয়ার সম্ভাবনা অতি সামান্য অর্থাত্ ২ শতাংশ।


অপারেশন:

সাধারণত ১০/২০% রোগীর ক্ষেত্রে অপারেশন দরকার, যখন মলদ্বারের গঠন প্রণালী ভীষণভাবে পরিবর্তিত হয়ে যায় যেমন বহির্স্থিত পাইলস, ঘা, পচন ধরা, বিসতৃত থ্রম্বোসিস, মলদ্বারের ভেতরের বৃদ্ধিপ্রাপ্ত মাংসপিন্ড অথবা সঙ্গে ফিসার থাকলে। অজ্ঞান না করে কোমরে ইনজেকশন দিয়ে রোগী সজাগ অবস্থায় অপারেশন করা যায়।  অপারেশনের ৬ ঘন্টা পর স্বাভাবিক খাবার দেয়া যায় যাতে পরদিন রোগী স্বাভাবিক মলত্যাগ করতে পারে। দিনে ২ বার নিতম্ব লবণসহ গরম পানিতে ডুবিয়ে শেক দিতে হয় ১০ মিনিট ধরে। ব্যথা নাশক ওষুধ ও মলম ব্যবহার করা যেতে পারে।

বিশেষ্ণ চিকিৎসক

আপনাকে যেতে হবে কোলোরেকটাল সার্জন এর কাছে। কোলোরেকটাল সার্জন এর সহায়তার জন্য নিন্মের লিংকে প্রবেশ করুনঃ